আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটছে হরদম। পোশাক ও বেশভুষায় এরা সত্যিকার র্যাব–পুলিশের মতো হওয়ায়, সাধারণ মানুষ এদের খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছে।
নগরীর পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন এলাকায় একই কায়দায় চলছে অপরাধ কার্যক্রম। অভিযোগ রয়েছে, এরা ধরা পড়ার পর জামিনে দ্রুত বেরিয়ে আসে এবং ফিরে যায় পুরোনো পেশায়।
এ ধরনের অপরাধী চক্রের দৌরাত্ম্য প্রসঙ্গে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, অপরাধী চক্রের প্রতারণার একটি কৌশল এটি। অপরাধ না করলেও হঠাৎ যখন তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে অভিযুক্ত করা হয়, তখন সেই ব্যক্তি ভড়কে যায়। আর সেই সুযোগে অপরাধীরা হাতিয়ে নেয়। তবে এখন এ ধরনের অপরাধীদের সম্পর্কে জনতা অনেকটা ওয়াকিবহাল। তাই অপরাধীরা ধরাও পড়ছে।
যেভাবে অপরাধ করে :
অভিযোগ রয়েছে, সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্যরা আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর পোশাক, বেল্ট, রিভলবার হোল্ডার, পুলিশের লোগোযুক্ত টর্চলাইট, হ্যান্ডকাফ, র্যাব–ডিবির পোশাক ও ব্যাজ ব্যবহার করছে। তাদের মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার ও মোটর সাইকেলে লাগানো থাকছে পুলিশ, ডিবি লেখা স্টিকার। দু–একজনের হাতে ওয়াকিটকিও থাকে। আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের মতো কথাবার্তা, আচরণও করে তারা। টার্গেট ব্যক্তিকে অনেক মানুষের সামনে থেকেই জোর করে গাড়িতে তুলে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে লাগিয়ে দেওয়া হয় হ্যান্ডকাফ, চোখ বেঁধে ফেলা হয় কালো কাপড়ে। চলন্ত মাইক্রোবাসের মধ্যেই দুর্বৃত্তরা শুরু করে মারধর। ভয় দেখায় ক্রসফায়ারের। জাল টাকার কারবারি, হুন্ডি ব্যবসায়ী, চোরাকারবারিণ্ডনানা অভিযোগ তুলে আটক ব্যক্তির টাকা–পয়সা, মোবাইল ফোনসেট, সোনার চেনসহ মূল্যবান সবকিছু হাতিয়ে নেওয়া হয়।
জানা গেছে, বাজারে চাইলেই মিলছে র্যাব ও পুলিশের পোশাক, ব্যাজ, বাঁশি, লাঠি ও হ্যান্ডকাফ। পেশাদার ধূর্ত অপরাধীরা আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিতে কৌশলে এসবের ব্যবহার করছে।
ঘটছে হরদম, ধরা পড়ছে কয়েকজন :
জানা গেছে, আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে হরদম অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। কিন্তু জানাজানি হচ্ছে মাত্র গুটিকয়েক ঘটনার কথা। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে এই চক্রের দুজনকে নগরীর কোতোয়ালী থানার রহমতগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তার দুই ভুয়া ডিবি পুলিশ হলো সাতকানিয়া উপজেলার দক্ষিণপাড়ার সতীশ মহাজনের পুলিন দাশের ছেলে নন্দন দাশ ওরফে বাবুল (৪৮) ও নগরীর বাকলিয়া থানার ডিসি রোড এলাকার সিরাজুর রহমানের ছেলে আারিফ মঈন উদ্দীন (৩৮)।
উপ–পুলিশ কমিশনার (উত্তর–দক্ষিণ) পরিতোষ ঘোষ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ডিবি পরিচয় দিয়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় মানুষজনকে তুলে নিয়ে অর্থ আদায় করে আসছিল চক্রটি। পাশাপাশি ডাকাতি, ছিনতাইয়ের সঙ্গেও জড়িত ছিল তারা। তাদের ধরতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযান চালিয়ে আসছিলাম। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমাদের কাছে খবর আসে, কয়েকজন সন্ত্রাসী অস্ত্রসহ ডিবি পুলিশ পরিচয়ে রহমতগঞ্জ এলাকায় ডাকাতি, ছিনতাই ও অপহরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ সংবাদের ভিত্তিতে নগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল ওই এলাকায় অবস্থান করে সন্ত্রাসীদের নজরদারিতে রাখে। এসময় ওই এলাকার কুসুমকুমারী সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস থেকে নেমে পাঁচ–ছয়জন ব্যক্তি পূর্ব দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল। তখন দুজনকে ধরে ফেলে গোয়েন্দা টিম।
আটক বাবুলের শরীরে তল্লাশি চালিয়ে দেশে তৈরি কাটা বন্দুক, এক জোড়া হ্যান্ডক্যাপ, চার রাউন্ড কার্তুজ ও একটি ব্যাটন এবং আরিফের শরীরে তল্লাশি চালিয়ে একটি প্রসেসসহ নাইন এমএম সদৃশ খেলনা পিস্তল, একটি গামছা, একটি বাঁশি, একটি মলম ও একটি ব্যাটন উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে।
এর আগে গত ৩ ডিসেম্বর এ ধরনের একটি চক্রের পাঁচ সদস্য ধরা পড়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে। পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা আজাদীকে জানান, সংখ্যায় এ চক্রের সদস্য সংখ্যা আট। একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে ভুয়া গোয়েন্দা পুলিশের এ গ্রুপটির তথ্য বেরিয়ে আসে। ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার নাসিরের ছোট ভাই।
হাটহাজারী এলাকার বাসিন্দা গোলাম কিবরিয়ার দুবাই শহরে একাধিক দোকান রয়েছে। একটি দোকানে চাকরি করে রিয়াজ ও মো. সারোয়ার। পাশাপাশি তাদের মাধ্যমে গোলাম কিবরিয়া নিয়মিত বাংলাদেশে স্বর্ণ পাচার করেন। রিয়াজ–সারোয়ারের মতো তার একাধিক বাহক আছে। রিয়াজ গত ২০ নভেম্বর এয়ার এরাবিয়ার একটি ফ্লাইটে করে শারজা থেকে চট্টগ্রামে আসে। শাহ আমানত বিমানবন্দরে তাকে গ্রহণ করে গোলাম কিবরিয়ার শ্যালক সামুনুল হক। তারা একটি সিএনজিচালিত ট্যাক্সি করে বাসার উদ্দেশে রওনা হয়। পথে ক্যাফে ডি মমতাজ রেস্তোরাঁয় দুজনে নাস্তা করতে নামে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রিয়াজ এই রেস্তোরাঁয় স্বর্ণের বার সামুনুলকে হস্তান্তর করার কথা। এ সময় সেখানে একটি মাইক্রোবাস, একটি কার ও একটি মোটরসাইকেলে করে আট যুবক উপস্থিত হয়। তারা নিজেদের গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) লোক দাবি করে রিয়াজ ও সামুনুলকে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। মাইক্রোবাসটি বড়পোল এলে সামুনুলকে নামিয়ে দেওয়া হয়।
পরদিন রিয়াজ জানায়, ছিনতাইকারীরা তাকে সারারাত আটকে রেখে স্বর্ণ ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে নগরীর সিআরবি সাত রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিয়েছে। এ ঘটনায় গোলাম কিবরিয়ার শ্যালক বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। শনিবার বন্দর থানায় মামলা দায়ের হবার পর পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা গত রোববার ভোরের মধ্যেই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেন। ছিনতাইয়ের নাটকে অংশ নেওয়া দিদার, মাকসুদ, মোহাম্মদ আলী, তুহিন, বক্কর, মুশফিক আহমেদ নিহান ও কামালকে ৪০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। অবশিষ্ট টাকা রিয়াদ ও সারোয়ার ভাগ করে নেয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত বক্কর, নিহান ও কামাল বর্তমানে পলাতক রয়েছে। এদের মধ্যে নিহান আইআইইউসির বাণিজ্য অনুষদের ছাত্র। কামাল উদ্দিন ওরফে চাকমা কামাল আরেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউএসটিসি থেকে পাস করে সদ্য বের হয়েছে। ছিনতাইয়ে অংশ নেয়া তুহীন ও নিহান ছাড়া বাকিরা ক্ষমতাসীন দলের একটি অঙ্গসংগঠনের রাজনীতির সাথে জড়িত।
পিবিআইয়ের পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, মামলার বিষয়টি জানার পর রাতেই আমরা পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
গত ৭ অক্টোবর পুলিশের বিশেষ শাখার এসপি পরিচয় দিয়ে প্রতারণা চেষ্টার অভিযোগে গাজীরুল হক (৪৮) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে হালিশহর থানা পুলিশ। হালিশহর থানার ওসি প্রণব চৌধুরী জানান, মইন্যাপাড়ায় আসাদ নামের একজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না খবর পেয়ে গাজীরুল সেখানে যায়। আসাদের পরিবারের কাছে নিজেকে ঢাকায় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের এসপি বলে পরিচয় দেয়। আসাদকে আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে গেছে এবং ৫০ লাখ টাকা দিলে আসাদকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবে বলে আশ্বাস দেয় গাজীরুল। প্রথম দিন চলে আসার পর বৃহস্পতিবার আবার আসাদের বাসায় যায় সে। স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে এ খবর পেয়ে অভিযান চালিয়ে গাজীরুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গত ৩ অক্টোবর পটিয়া থানায় এসে নিজেকে পুলিশ কর্মকর্তা দাবি করে বসে এক ব্যক্তি। পরে অবশ্য থানায় থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের সন্দেহ হলে তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হওয়া যায় সে সত্যিকারের পুলিশ কর্মকর্তা নয়। নিজেকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছিল ওই ব্যক্তি। আটক ব্যক্তির নাম মো. ইমাম হোসেন আবির (২৪)। সে নিজেকে উপ–সহকারী পুলিশ পরিদর্শক (এএসআই) বলে পরিচয় দিয়েছিলেন।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি হিমাদ্রি বিশ্বাস (২৮) নামে এক ভুয়া পুলিশ কর্মকর্তাকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। সে পেশায় একজন প্রকৌশলী। ফেইসবুক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট হ্যাক করে টাকা আদায় ও পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে প্রতারণার অভিযোগে তাকে আটক করা হয়েছিল। তার থেকে ‘অফিসার, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, চিটাগং ডিভিশন’ লেখা প্রায় দুশ ভিজিটিং কার্ড, একই ধরনের লেখা সম্বলিত সিল, স্ট্যাম্প প্যাড, পেনড্রাইভ, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের কয়েকটি হার্ডডিস্ক উদ্ধার করা হয়। azadi
পাঠকের মতামত: